করোনাভাইরাস মহামারি পরিস্থিতিতেও বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেলের নির্মাণ কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। ইতোমধ্যে অর্ধেকের বেশি (প্রায় ১১.০০ কিলোমিটার) ভায়াডাক্ট দৃশ্যমান হয়েছে। ডিপোর অভ্যন্তরে ২.৭০ কিলোমিটার রেল লাইন বসানো হয়েছে। ডিপোর অভ্যন্তরে মোট ৫২ টি অবকাঠামো নির্মাণ কাজ পুরোদমে এগিয়ে চলছে। ডিপো এলাকার পূর্ত কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৭৩ শতাংশ। মেট্রোরেলে প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে হয়েছে ৫০.৪০ শতাংশ।
রাজধানীর যানজট কমাতে ও নগরবাসীর যাতায়াত আরামদায়ক দ্রুততর নির্বিঘœ করতে মেট্রোরেল নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটার বেগে যাত্রী নিয়ে ছুটবে মেট্রো ট্রেনে। উভয়দিক থেকে ঘণ্টায় ৬০ হাজার যাত্রী পরিবহন বহনে সক্ষমতা থাকবে মেট্রোরেলের।
এ দিকে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ছয় লেনের মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। এর মধ্যে দুটি রুট নিমার্ণের কাজ শিগগিরই শুরু করতে যাচ্ছে সরকার। এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৪ হাজার কোটি টাকার মতো।
শনিবার সকালে মন্ত্রীর সরকারি বাসভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে ব্র্যাক-বিশ্বব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে আলোচনা সভায় যুক্ত হয়ে এসব কথা বলেন কাদের।
সেতুমন্ত্রী বলেন, আগামী দুই থেকে তিন বছরের মধ্যে বাংলাদেশের সড়ক নেটওয়ার্কে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধিত হবে। বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থায় যে পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে তা ৩০ বছর আগে করা উচিত ছিল। আগের সরকারগুলো সেসব করেনি। বর্তমান সরকার সেতু, মেট্রোরেল, চারলেন, ছয়লেন মহাসড়কসহ ভবিষ্যতের জন্য নানামুখী পরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।
তিনি জানান, উন্নত বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে চালু হয়েছে রোড সেফটি অডিট।
কাদের বলেন, পুরুষদের তুলনায় মহিলা গাড়ি চালকরা অধিক সাবধানী ও আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। সরকারও মহিলা গাড়ি চালক তৈরির সুযোগ বাড়াচ্ছে।
আলোচনায় ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ বলেন, নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে জনসচেতনতা, প্রশিক্ষিত গাড়িচালকের বাড়ানোসহ নানামুখী কাজ করতে হবে। ব্র্যাক এ কাজে নিবিড়ভাবে অংশগ্রহণ করতে উদ্যোগ নিয়েছে। বিশ্বব্যাংক এক্ষেত্রে সহযোগিতা করবে।
বিশ্বব্যাংকের সড়ক যোগাযোগ বিভাগের বিশ্লেষক সন্দীপন বসু বলেন, অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশের মতো বাংলাদেশও ২০৩০ সালের মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনতে অঙ্গীকারাবদ্ধ। এখন পর্যন্ত নেয়া উদ্যোগকে ইতিবাচকই বলা যায়। মনে রাখতে হবে সড়ক দুর্ঘটনায় কেবল প্রাণহানি বা অঙ্গহানির মতো ঘটনায় ঘটে না। অর্থনীতি ও উন্নয়নের মানও প্রশ্নবিদ্ধ হয়, বাধাগ্রস্ত হয়।
আলোচনায় বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের আবাসিক প্রতিনিধি দানদান শ্যান, ব্র্যাকের পরিচালক আহমেদ নাজমুল হুসেইন অংশ নেন।
প্রকল্পের অগ্রগতির খোঁজ নিয়ে জানা যায়,বাংলাদেশের প্রথম মেট্রোরেল ২২.১০ কিলোমিটার দীর্ঘ যা রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ি থেকে মতিঝিল পর্যন্ত কাজ চলমান রয়েছে। উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৭৬.৩৭ শতাংশ। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল অংশের কাজের অগ্রগতি হয়েছে ৪৩.৪৬ শতাংশ।
তাছাড়া, ইলেকট্রিক্যাল ও মেকানিক্যাল সিস্টেম এবং রোলিং স্টক (রেলকোচ) এবং ডিপো ইকুইপমেন্ট সংগ্রহ কাজের সমন্বিত অগ্রগতি হয়েছে ৩৪.৭৪ শতাংশ। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুসারে মতিঝিল থেকে কমলাপুর পর্যন্ত এমআরটি লাইন-৬ এর বর্ধিত করার কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এই অংশের দৈর্ঘ্য ১.১৬কিলোমিটার।
প্রকল্প থেকে জানা যায়, উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১.৭৩ কিলোমিটার ভারপ্রাপ্ত এবং ৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হবে। ৯টি স্টেশনের সাবস্ট্রাকচার নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের কনস্ট্রাকশন ছাদ নির্মাণ সমাপ্ত হয়েছে। বর্তমানে উত্তরা উত্তর, পল্লবী, কাজীপাড়া এবং শেওড়াপাড়ায় স্টেশনের কনস্ট্রাকশনস নির্মাণের কাজ চলছে। তাছাড়া উত্তরা সেন্টার স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম নির্মাণের কাজ চলমান আছে। উত্তরা সেন্টার ও উত্তরা দক্ষিণ স্টেশনের মেকানিক্যাল ইলেকট্রিক্যাল ও প্লাম্বিং এর কাজ শুরু হয়েছে।
একইসাথে আগারগাঁও থেকে কারওয়ান বাজার পর্যন্ত ৩.১৯৫কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও ৩টি স্টেশন নির্মাণ কাজ চলমান আছে। তাছাড়াও এই অংশে পিয়ার কলাম, পাইল ক্যাপ, ফ্রামগেট স্টেশন নির্মাণ, পিয়ার হেড, প্রিকাস্ট সেগমেন্টসহ নানা কাজ চলমান রয়েছে।
কারওয়ান বাজার থেকে মতিঝিল পর্যন্ত ৪.৯২২ কিলোমিটার ভায়াডাক্ট ও ৪ টি স্টেশনের নির্মাণ করা হবে। এই অংশে পরিষেবা স্থানান্তর, চেকরোবিং, ট্রায়াল ট্রেঞ্চ, টেস্ট পাইল এবং সকল স্থায়ী বোরড পাইল নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। তাছাড়াও পিয়ার কলাম, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশনের সাবস্ট্রাকচার নির্মাণ কাজ,পাইল ক্যাপ, পিয়ার হেড, সেগমেন্ট এর নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।
মেট্রো ট্রেনের বিষয়ে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এন এ ছিদ্দিক বলেন, জাপানে মেট্রো ট্রেনের নির্মাণকাজ চলছে। ইতিমধ্যেই দুটি ট্রেনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে। আরও তিনটি মেট্রো টেনের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। বাংলাদেশ এবং জাপান উভয় দেশের করোনা পরিস্থিতির উপর বিবেচনা করে এই পাঁচটি ট্রেন একবারে দেশে নিয়ে আসা হবে। সে ক্ষেত্রে বর্তমানে বাংলাদেশে এবং জাপানের করোনা পরিস্থিতি এই অবস্থায় যদি বিরাজ করে তাহলে আমরা আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে নিয়ে আসতে পারবো পাঁচটি মেট্রো ট্রেন’।
তিনি আরও বলেন, করোনা পরিস্থিতির পর কাজ এখন পুরোদমে চলছে। চলমান করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রথম পর্যায়ে গাবতলী কনস্ট্রাকশন ইয়ারে ১০ শয্যা বিশিষ্ট এবং উত্তরাস্থ পঞ্চবটি কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ডে ১৪ শয্যাবিশিষ্ট হসপিটাল নির্মাণ করা হয়েছে। পরামর্শক প্রতিষ্ঠান, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, সকল পর্যায়ের জনবলে কাজে যোগদানের জন্য কোভিড-১৯ এর উপসর্গ আছে কিনা তা যাচাই বাছাই করা হয়, তারপরেই কাজে যোগদানের অনুমতি দেওয়া হয়’।
উল্লেখ্য, এমআরটি লাইন-৬ নামে মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ ২০১২ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়। প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিলের ৫ হাজার ৩৯০ কোটি টাকা এবং জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) ঋণ থেকে ১৬ হাজার ৫৯৪ কোটি টাকা ব্যয় হবে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে মেট্রোরেল চালুর পরিকল্পনা আছে সরকারের।
Leave a Reply