শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে সনাতন ও মুসলিম ধর্মাবলম্বী প্রেমিক যুগলের ফেসবুকে প্রেমের বাস্তব চিত্রনাট্য রচনা করে সিনেমা-নাটককেও হার মানিয়েছে । সাত- আট মাসের প্রেমকে শুধু গল্পই বানায়নি তারা, রীতিমতো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ঘুম হারাম করে ঝড় তুলেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমেও। ‘সি ইজ ডেট’ শিরোনামে ভাইরাল হওয়া এ গল্পের শুরু উপজেলার ভটপুর গ্রাম ও গাজিপুরের হোতাপাড়া থেকে। ভটপুরের সনাতন ধর্মাবলম্বী এক কৃষক পরিবারের দশম শ্রেণি পড়ুয়া কন্যা ধর্মান্তরিত তাবাচ্ছুম মৃধা ও গাজিপুরের হোতাপাড়া এলাকার একটি সিরামিক কারখানার শ্রমিক ও দশম শ্রেণি পড়ুয়া যুবক মাহদি মৃধাকে ঘিরে শুরু হয় বাস্তব জীবনের প্রেম কাহিনী।ঘটনার শুরু প্রায় আট মাস আগে। রাইফা নামে নবম শ্রেণি পড়ুয়া এক বালিকার সাথে ফেসবুকে পরিচয় ও যোগাযোগ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই অনলাইন মার্কেটিং করতো নালিতাবাড়ীর ভটপুর গ্রামের সনাতন ধর্মাবলম্বী বালিকা ও আন্দারুপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী তাবাচ্ছুম মৃধা (বর্তমান নাম)। সে সুবাদে রাইফার মিউচ্যুয়াল ফ্রেন্ড হিসেবে সামনে পেয়ে তাবাচ্ছুমের ব্যবহৃত ‘অনুরাধা সেন’ নামে ফেসবুক আইডিতে ফ্রেন্ড রিকুয়েস্ট পাঠায় মাহদি মৃধা। রিকুয়েস্ট গ্রহণ করার পর মাহদি ও তাবাচ্ছুম এর মাঝে যোগাযোগ শুরু। একপর্যায়ে প্রেমের গল্প গড়ে উঠে দুজনের মাঝে। ম্যাসেঞ্জার ও মোবাইল ফোনসহ ভার্চুয়াল মাধ্যমে দু’জনের মাঝে গভীরতা দিনকে দিন বাড়তে থাকে।২৪ জুলাই রোববার তাবাচ্ছুম এর শিখিয়ে দেওয়া কথামতো গল্প তৈরি করে মাহদি। মাহদি তার মোবাইল নাম্বার থেকে তাবাচ্ছুম এর মায়ের ফোনে কল করে। বলা হয়, ‘স্থানীয় এমপি মতিয়া চৌধুরীর পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের জন্য স্কুলে বৃত্তির টাকা দেওয়া হবে। তাবাচ্ছুমকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে হবে। তাই বাড়ি থেকে তাবাচ্ছুমকে আন্দারুপাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে আসতে দেওয়া হয়। ঘটনা সকাল দশটার দিকে। তাবাচ্ছুম বিদ্যালয়ে এলেও ফিরে যায়নি বাড়িতে। দিনভর না আসার একপর্যায়ে খোঁজাখুঁজি। পরদিন পর্যন্ত তাবাচ্ছুম এর সন্ধান মেলেনি। ফোনে বারবার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয় তার পরিবার।একপর্যায়ে তার বাবা কোটেশ্বর বর্মণ সোমবার রাতে নালিতাবাড়ী থানায় সাধারণ ডায়েরি করে। জানানো হয় র্যাবকেও। শুরু হয় খোঁজাখুঁজি। কিন্তু সাড়া পাচ্ছিল না কেউ। একপর্যায়ে মঙ্গলবার (২৬ জুলাই) ‘অনুরাধা সেন’ নামে ফেসবুক আইডিতে (তাবাচ্ছুম এর আইডি) তাবাচ্ছুম এর মুখ বাঁধা মৃত লাশের মতো পড়ে থাকা একটি ছবি আপলোড করা হয়। সেখানে বলা হয়, ‘না খুঁজলেই ভালো। খুঁজেও লাভ হবে না। সি ইজ ডেড।’ এ পোস্ট দেখে তাবাচ্ছুম এর পরিবারের পক্ষ থেকে ওই আইডিতে কল করা হয়। তখন দুইজন পুরুষের কণ্ঠ শোনা যায়। ৪৯ সেকেন্ডের কথায় সেখান থেকে বলা হয়, ‘আমার বান্ধবী আর বেঁচে নেই।’ এরপর ওই আইডিও ডিএ্যাক্টিভ করে দেওয়া হয়।এরপরই শুরু হয় তোলপাড়। দুঃশ্চিন্তায় ভেঙে পড়ে তাবাচ্ছুম এর পরিবার। মুখ বাঁধা মৃত লাশের মতো পড়ে থাকা ছবি ছড়িয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ঝর ওঠে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী থেকে সর্বত্র। অনিশ্চয়তায় পড়ে যান সকলেই।
অপরদিকে ঘটনার দিন ২৪ জুলাই বিকেল চারটার দিকে তাবাচ্ছুম পৌছে যায় গাজিপুরে। মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে মিলিত হয় মাহদি ও তাবাচ্ছুম। ভালোবাসার টানে পরিকল্পনামাফিক তাবাচ্ছুমকে মাহদি নিয়ে যায় তার বাসায়। প্রথমে পরিবারের লোকজন সম্মত না হলেও একপর্যায়ে উভয়ের বিয়ে দিতে সম্মত হয়। সোমবার গাজিপুরের আদালতে গিয়ে এফিডেভিট করে সনাতন ধর্ম পাল্টে মুসলিম হয় তাবাচ্ছুম। এরপর তারা বিয়ে করে সোমবার থেকেই সংসার জীবন শুরু করে।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ গণমাধ্যমে অপহরণের পর হত্যা’র খবর ছড়িয়ে পড়লে থানা পুলিশ হন্যে হয়ে মাঠে নামে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে পুলিশের একটি দল চলে যায় গাজিপুরে। ২৯ জুলাই শুক্রবার রাত থেকে ৩০ জুলাই শনিবার দুপুর পর্যন্ত তারা গাজিপুরে অভিযান অব্যাহত রাখে। বেলা দুইটার দিকে প্রথমে বাড়ি পৌছে উদ্ধার করে তাবাচ্ছুমকে। এর কিছুক্ষণ পর বাড়ির কাছ থেকেই আটক করে মাহদিকে। রাতে আনা হয় নালিতাবাড়ী থানায়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে উঠে আসে রোমাঞ্চকর প্রেমের পুরো ঘটনা।
গল্পের রচয়িতা হিসেবে উঠে আসে তাবাচ্ছুম এর নাম। অনেকটা সাদাসিদে টাইপের মাহাদি প্রেম করে প্রেমিকাকে পাওয়ার জন্যই আবেগী। কিন্তু তাবাচ্ছুম এটিকে পরিণয়ে রূপান্তর করতে পুরো গল্প বানায়। তার শেখানো গল্পেই দু’জনের মিলে তৈরি করে ভিন্নধর্মী লাভ স্টোরি। বারবার জিজ্ঞাসাবাদেও নিজে এ পরিকল্পনার দায় নেয় তাবাচ্ছুম। মাহদি বারবারই বিষয়টি নিছক ভালোবাসা হিসেবেই বুঝানোর চেষ্টা করে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে তাবাচ্ছুম জানায়, বাবা-মায়ের জন্য খারাপ লাগে ঠিকই, কিন্তু সে মাহদিকে ছাড়া থাকবে না, বাবার কাছেও যাবে না। জন্ম নিবন্ধন সনদে বয়স কম থাকলেও নিজের বয়স ১৮ হয়েছে বলে দাবী করে সে। বলে নিবন্ধনের সময় বয়স ভুল করে কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সনদে তার বয়স ১৩ অক্টোবর ২০০৫ দেখানো হলেও তার জন্ম ২০০৩ সালে।
তাবাচ্ছুম জানায়, সে নিজেই মাহদিকে ফোন করে গাজিপুরে যায়। প্রথমে অটোবাইকে নালিতাবাড়ী, এখান থেকে সিএনজিতে নকলা, তারপর আবার পাবলিক বাসে করে গাজিপুর। এভাবে একাই পৌছে যায় প্রেমিক মাহদির কাছে। এর জন্য কিছুদিন আগে বড় বোনের বিয়েতে হাত খরচ হিসেবে বাবার দেওয়া ১৫শ টাকা জমিয়ে রাখে তাবাচ্ছুম।
সে আরও জানায় মারা গেছি বলে প্রচার দিলে আমাকে আমার পরিবার আর খোজাঁখুজি করবেনা,তার জন্যই সিমা বর্মন যার নতুন নাম তাবাচ্ছুম নিজেই তার মুখে উড়না দিয়ে বেধে ছবি তোলে নিজের ফেসবুকে পোস্ট করেন‘ সি ইজ ডেড’লিখে ।
এ বিষয়ে সর্বশেষ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বছির আহমেদ বাদল জানান এপর্যন্ত আমাদের জিজ্ঞাসাবাদে তাবাচ্ছুম এবং মাহাদি স্বিকার করেছেন যা করেছি প্রেমের জন্যই করেছি , মেয়ের পরিবারের পক্ষ থেকে এখনো কোন মামলা করা হয় নাই,যদি মামলা করা হয়,সেই মোতাবেক ব্যাবস্থা নেওয়া হবে ।
Leave a Reply